চাকরি নাকি ফ্রিল্যান্সিং? 2024

সব কাজ শিখে যখন কাজ করার জন্য প্রস্তুত, তখন ক্যারিয়ারের পথ দুটি- চাকরি অথবা ফ্রিল্যান্সিং। এ দুই ক্যারিয়ারের কোনটিকে আপনি বাছাই করবেন, সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব আজকের পর্বে।


১) ইচ্ছেমতো ঘুরি, ইচ্ছেমতো ঘুমাইচাকরি মানেই সকাল ৯-৫টা পর্যন্ত অফিস করা। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে অফিসে প্রবেশ করতে না পারা মানেই বসের ঝাড়ির অপেক্ষা, সেই সঙ্গে মাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট একটা অংশ হিসাব করে কেটে নেয়া হবে। অফিসে প্রবেশের এ দেরিটা যানজট কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সার হলে ইচ্ছেমতো সময়ে ঘুম, ইচ্ছেমতো সময়ে ঘুম থেকে উঠলেও কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। শুধু সময় অনুযায়ী বায়ারের কাজ জমা দেয়াটাই আসল কাজ। সেটি দিনে করা হচ্ছে নাকি রাতে, সেটি কারও জন্যই টেনশনের বিষয় নয়।

২) হতে চাই নিজের বসঃচাকরি মানেই যে কোনো কাজের ভুল কিংবা যে কোনো অপরাধের জন্য বসের রুমে দুরুদুরু বুকে দাঁড়ানো, পরে এ অপরাধের জন্য বসের মুখ থেকে অপমানজনক বোকাঝকা শোনা। যে কোনো চাকরিজীবীদের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত এ বিষয়টি মেনে নেয়া গেলেও চাকরি করার বয়সে এসে এ ধরনের অপমানগুলো সহ্য করা অনেক সময়ই মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হয়। কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে অনেক সময় সবই মেনে নিতে হচ্ছে, শুধু সুযোগের অপেক্ষা।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সার মানেই হচ্ছে নিজেই বস। কোনো বসের বকাঝকা খাওয়ার ভয় এ জগতে নাই। পকেট খালি থাকলে কাজ করব, না প্রয়োজন হলে নতুন করে কোনো কাজে যুক্ত হব না। কাজ না করলে কারও কোনো বাধা নাই।

৩) জগতটা ঘুরে দেখাটাই নেশাঃচাকরিজীবীদের ছুটির দিন একদিন কিংবা সর্বোচ্চ দুদিন। প্রতিদিন সকাল ৯-৫টা পর্যন্ত অফিস করার কারণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের ব্যক্তিগত কিংবা পরিবারের বিভিন্ন কাজের চাপ এসে পড়ে। সেজন্য ভ্রমণ পিপাসুদের ভ্রমণের নেশাকে ভুলে যেতে হয়। মুক্ত পাখির মতো বিশ্বব্যাপী ছুটে বেড়ানোর স্বপ্ন বাদ দিয়ে চাকরির যান্ত্রিক জীবনটাকেই বেছে নিতে হয়।





যখন আপনি ফ্রিল্যান্সারঃকোন জায়গাতে বসে বায়ারের কাজ করছেন এবং জমা দিচ্ছেন, সেটি ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নয়। আর এটাই হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের আসল মজা। ভ্রমণে বের হয়ে সমুদ্রের পাশে বসে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসেও বায়ারের কাজ সম্পন্ন করা যায়। ঘুরাঘুরি এবং কাজ দুটি সমানতালে করার সুযোগ রয়েছে ফ্রিল্যান্সারদের।

৪) দরকার বড় অংকের মাসিক আয়ঃচাকরিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেতন হতে পারে ৮ হাজার টাকা কিংবা কারও আরও বেশি হলে হয়তো ৫০ হাজার টাকা হতে এক লাখ টাকা হতে পারে বেতন। কম টাকা বেতনের কারণে নিজের অনেক স্বপ্নকে মনের ভেতরেই কবর দিয়ে দিতে হয়। আবার এ টাকাতেই অনেকে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন হয়তো। কারণ এর চেয়ে বড় স্বপ্ন এখনও দেখতে পারছেন না।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : এদেশের প্রচুর ফ্রিল্যান্সার রয়েছে যারা স্টুডেন্ট অবস্থাতেই মাসে লাখ টাকার ওপরে অনলাইন থেকে আয় করছে। বাংলাদেশের একজন গ্রাজুয়েটের যেখানে চাকরিতে মাসিক বেতন হয় ৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে অনেক ফ্রিল্যান্সার দেখা যায়, যাদের এটা মাত্র ১ সপ্তাহের আয়, অথচ সে ফ্রিল্যান্সার হয়তো এখন গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেনি।

৫) চাকরির কারণে পরিবারকে মিসঃপরিবারকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য চাকরি শুরু করলেও, এ চাকরি পরিবারের লোকদের প্রাপ্য স্নেহ, ভালোবাসার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সারাদিন অফিসের ব্যস্ততার জন্য অনেককেই দেখা যায়, পরিবারের লোকদের সময় দিতে পারেন না। সন্তান, বউ কিংবা স্নেহের ছোট ভাইবোনরা আদর থেকে বঞ্চিত হয়। সকাল ৯টায় অফিস শুরু করে যদি বাসাতে পৌঁছে রাত ১০টার পর, তাহলে কীভাবে পরিবারের লোকজন পাশে পাবে।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : পরিবারের সবারই স্বপ্ন থাকে প্রতিবেলাতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার। চাকরিজীবীরা পরিবারের মানুষদের এ দাবিটা মিটাতে না পারলেও ফ্রিল্যান্সারদের পক্ষে সম্ভব। কারণ ফ্রিল্যান্সারদের কোনো অফিসে গিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয় না, কোনো নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বন্দি থাকতে হয় না। চাইলে যখন ইচ্ছা পরিবারের সবাইকে মিলে সিনেমা দেখে আসতে পারে কিংবা বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতেও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বাধা নাই।

৬) মন তো চায় প্রতিষ্ঠানের মালিক হবঃহয়তো এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যারা চাকরি করতে গিয়ে স্বপ্ন দেখে না যে, সে নিজেই একদিন বস হয়ে নিজের একটি অফিস খুলে বসবে। এ ইচ্ছেটা কমবেশি সবারই মনে রয়েছে। মন চায়, অন্যের অফিসে চাকরি করব না, আমার নিজের অফিসে চাকরি করবে অনেকজন, শুনবে সবাই আমার নির্দেশ, আমাকে কারও নির্দেশ শুনতে হবে না। কিন্তু এরকম হওয়াতো সম্ভব না। চাকরি করে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটি দিয়ে নিজের চলতেই কষ্ট হয়, অফিসের স্বপ্ন দেখব কীভাবে? অফিসের জন্য আয় করবই কীভাবে?

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সারঃএকজন ফ্রিল্যান্সার জানে অনলাইন হতে কীভাবে কাজ জোগাড় করা যায়। ১-২ বছর যাওয়ার পর অনেক ফ্রিল্যান্সারদেরই কাজের চাপ বেড়ে যায়। তখন সেই কাজ করানোর জন্যই বাধ্য হয়ে কাজ করার জন্য অনেকজন লোক খুঁজে নিতে হয়। এবং তখন পূরণ হয় বহুদিনের বস হওয়ার স্বপ্নটি।

৭) যানজট কমিয়ে দিচ্ছে কাজের সময়ঃপ্রতিদিন অফিসে যেতে এবং আসতে যানজটের জন্য কমপক্ষে ৫-৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। কিছুই করার নেই, ঢাকা শহরে থাকতে হলে এবং অফিসে গিয়ে চাকরি করতে হলে এটা মেনে নিতেই হবে। যানজটে নাকাল আবার তার ওপর দেরি হলে বাড়তি বসের ঝাড়ি এবং বেতন কাটা, এগুলো বাড়তি পাওনা। কিন্তু এদেশে অফিস করতে গেলে যে যানজটের কারণে কখন অফিসে ঢুকতে পারবেন, নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এ বিষয়টা সবাই বুঝলেও অফিস বসরা বুঝতে চায় না।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : যানজটের ঝামেলাতে বিরক্ত হয়ে অনেকেই সমাধান হিসেবে ফ্রিল্যান্সার পেশাটাকেই এখন পছন্দ করছে। প্রতিদিন রুটিন মেনে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে অফিস করার ঝামেলামুক্ত থাকা যাচ্ছে। নিজের ঘরটাই তখন অফিস, আবার সেই অফিসে নিজেই বস।

৮) ঘর থেকে বের হলেই অনিশ্চিত জীবনঃবর্তমানে রাস্তাতে বের হলেই পরিবারের লোকজন টেনশনে থাকেন ঘরে আবার ফিরতে পারবে তো। প্রতিদিন সকালে অফিসের জন্য যখন বের হয়, তখন থেকেই শুরু হয় এ টেনশন, অফিস থেকে বাসাতে ফেরার আগ পর্যন্ত এ টেনশন কাজ করে। রোড অ্যাক্সিডেন্ট থেকে শুরু করে অন্য অনেক ধরনের ভয় নিয়েই ঘর থেকে বের হতে হয় চাকরিজীবীদের।

যখন আপনি ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সারদের জন্য রাস্তাঘাটের ঝামেলামুক্ত জীবন। ঘরে বসেই যদি চাকরিজীবীদের চাইতে ভালো আয় করা যায়, তাহলে কেন রাস্তাঘাটে বের হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে? নিজের অন্য অনেক প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু সেটাতো আর প্রতিদিন রুটিন মাফিক টেনশন না।

আরও কারণে চাকরিজীবী না হয়ে ফ্রিল্যান্সার হওয়া যেতে পারে। তবে চাকরিজীবী হওয়ার পক্ষেও অনেক যুক্তি রয়েছে।



-চাকরি করতে গেলে অফিসের অন্যদের থেকে শেখা যায় অনেক কিছু। ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে নিজে নিজে কিংবা নতুন কিছু শিখতে হলে সম্পূর্ণভাবে অনলাইনের ওপর নির্ভর করতে হয়।

-চাকরিজীবীদের জন্য প্রতি মাসের নির্দিষ্ট একটা বেতনের নিশ্চয়তা থাকলেও অনেক সময় নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে সেটা থাকে না।

-চাকরিজীবীদের জীবনে যে শৃংখলা থাকে, সময়ানুবর্তিতার চর্চা থাকে ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।

-এখনও আমাদের সমাজে ফ্রিল্যান্সারদের সেইভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না, যেমন দেয়া হয় চাকরিজীবীদের। সেজন্য বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ঝামেলাতে পড়তে হয় ফ্রিল্যান্সারদের।

-অনেক ফ্রিল্যান্সাররা ঘরকুনো বেশি হওয়ার কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

চাকরিজীবী হবেন নাকি ফ্রিল্যান্সার হবেন সেটি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত। সবক্ষেত্রে ভালো-খারাপ দুদিকই রয়েছে। তবে এখনও এদেশে ফ্রিল্যান্সিংটাকে কেউ পেশা হিসেবে নিতে ভয় পায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক কারণে। তবে অবশ্যই খুব শিগগিরই এর পরিবর্তন আসবে। তখন হয়তো দেখা যাবে, লোকাল অফিসগুলো ফ্রিল্যান্সার হিসেবেই তাদের অফিসের লোক নিয়োগ দেবে। অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না, ঘরে বসেই অফিস করার সুযোগ থাকে না। অনলাইনে যোগাযোগের এ যুগে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসবে


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

Related Post List in BlogPost